সোমবার, ২৩ মে, ২০২২

ভারতীয় রাজনীতিতে রবার্ট লর্ড ক্লাইভের উত্থান

lord-clive-in-india
চিত্র: রবার্ট লর্ড ক্লাইভ

সজল দাশগুপ্ত: ভারতীয় রাজনীতিতে বিদেশী বণিকদের হস্তক্ষেপ দেশীয় রাজনীতিতে এক অন্য ইতিহাস রচনা হয়েছিলো। আর সেই রচিত যাত্রা শুরু হয় লর্ড ক্লাইভের হাত ধরে। লর্ড ক্লাইভ ১৭২৫ সালে ২৯শে সেপ্টম্বর এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। রবার্টের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উকিল। সম্রাট হেনরি দ্বিতীয় আমলে ক্লাইভ পরিবারের একটি ছোটো জমিদারী ছিলো। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রবার্ট শিশুকাল থেকে গরম মেজাজি ছিলো। অল্পতেই রেগে যেতো এবং সারা মারাপিট জনিত কাজে লিপ্ত ছিলেন। এমনকি এহেন কাজের জন্য তার একাধিক স্কুলও পরিবর্তন করতে হয়েছিলো। রবার্টের জীবনে ১৭৪৪ সালে মূল ঘটনার সুত্রপাত। ক্লাইভের বয়স যখন ১৮ তখন তার বাবা তার জন্য একটি চাকরি জোগাড় করে দিলেন। 

অথাৎ ব্রিটেনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সামান্য কেরানি হিসেবে। তার চাকরির স্থান হিসেবে দিয়েছিলো ভারতের মুম্বাই শহরে। মজার বিষয়, ব্রাজিল হয়ে ভারতে জাহাজে করে আসার সময় প্রায় ৯ বার জাহাজ খারাপ হয়েছিলো। সেই সময় তিনি ওই টানা ৯ মাসে কিছু পর্তুগিজ ভাষা রপ্ত করেন। কেননা সেই সময় ভারতে পর্তুগিজদের আধিপত্য ছিলো। বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই, মুম্বাই, এবং কলকাতা শহরের কিছু স্থানে। জানা যায়, সেসময় চেন্নাইয়ের মাদ্রাজাপত্তনম নামক এক গ্রামে কোম্পানির সেন্ট জর্জ দুর্গ ছিল। ১৭৪৪ সালে জুন মাসে লর্ড ক্লাইভ সেই মাদ্রাসের সেন্ট জর্জ দুর্গ ঘাটিতে পৌঁছান। সেখানে দু-বছর থেকে এক দোকানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এই সময় তিনি গর্ভনর লাইব্রেরিতে যাতায়াতের অনুমতি পান এবং সেখানে বিভিন্ন প্রকারের বই পড়তে সুযোগ পান। 


প্রসঙ্গত, ক্লাইভ আসার ১৭০৭ সালে অথাৎ ৩৭ বছর আগে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব মারা যান। সেই সময় দেশীয় ক্ষমতা যায় সুবেদারদের হাতে। মানে হায়দ্রাবাদের নিজামের হাতে এবং কর্ণাটকের নবাব আনোয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ খানের হাতে। এই সময় চতুর লর্ড ক্লাইভ ভাবলেন, একদিকে আধিপত্য পর্তুগিজদের এবং অন্যদিকে ফরাসি, ওলন্দাজ। একবার স্থানীয় শাসন কর্তাদের কাছে টানতে পারলেই ব্যবসা ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ। এরপরই বাঁধে কর্ণাটকের যুদ্ধ। যা সংঘটিত হয় ১৭৪৫ সালে। ফরাসিরা আক্রমন করে ব্রিটিশদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে। ব্রিটিশ সাহেবদের গ্রেফতার করে বলিয়ে নেওয়া হয় তারা ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেনা। এবং তাদের পন্ডিচেরীতে পাঠানো হলো। কিন্তু লর্ড ক্লাইভ ছিলেন নাছরবান্দা। কিছুতেই সেই শপথ গ্রহণ করলেন না লর্ড ক্লাইভ। এরপরই ক্লাইভ প্রাণ বাঁচাতে ফরাসি প্রহরীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ওখান থেকে চম্পট দেয়। ফিরে যান লন্ডনে। আবার ১ বছর বাদে ফিরে আসেন ভারতে। এসেই দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধে বীরত্ব দেখায়। উল্লেখ্য, সেই যুদ্ধে ক্লাইভের পক্ষের একজনেও প্রাণহানি ঘটেনি। 

এরপর, ক্লাইভ বাংলায় এসে একটি খারাপ খবর শুনতে পারে। মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দি খানের পর তারই নাতি সিরাজ উদ-দৌল্লাহ নবাব হয়েছেন। সেই নবাব নাকি কলকাতায় ব্রিটিশ দুর্গ ধংস করে নিজের দঃখলে এনেছেন এবং ব্রিটিশ সেনাদের বন্দি করে কৃষ্ণগুহাতে আটকে রেখেছেন যেখানে ১৪৫ জনের মধ্যে ১২৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ফলে লর্ড ক্লাইভের মনে জ্বলতে থাকে প্রতিশোধের আগুন। এরপরের ইতিহাস সবাই জানা কম-বেশী। সালটা ১৭৫৭ সাল। 


অনন্য দিনের মত, সেদিনও উঠেছিল সূর্য, কিন্তু সেদিনই উঠে ডুবে গেলো স্বাধীনতার সূর্য, পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজের পক্ষে ছিল ৫০,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী, অস্ত্র, গোলাবারুদ, হাতি, ঘোড়া কোনোদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল না নবাবের বাহিনী। আর ইংরেজ পক্ষে ছিল মাত্র হাজার তিনেক সৈন্য, তাও অপ্রশিক্ষিত এবং ভাড়া করে নিয়ে আসা। কিন্তু নবাবের সেনাদের মধ্যে ৪০,০০০ সৈন্যই ছিল মীর জাফর সহ বিশ্বাসঘাতক সেনানায়ক রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফদের অধীনে। আর যুদ্ধক্ষেত্রে তারা নিয়েছিল নীরব ভূমিকা।এই যুদ্ধে সেনাপতি মীর মদন ও মোহনলাল ছাড়া আর যে কয়েকজন নিজের বাংলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, তারা হচ্ছেন- বন্দুক বাহিনীর কমান্ডার বাহাদুর আলি খান, গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক নয়ে সিং হাজারি প্রমুখ।  

যুদ্ধের প্রথমেই বীর সেনাপতি মীর মর্দান ইংরেজ বাহিনীকে একদম কোণঠাসা করে ফেলেন। তবে ইংরেজরা এতটা প্রতিরোধ আশা করেনি নবাবের বাহিনী থেকে। ক্লাইভ বিচলিত হয়ে গেছিলো! কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলো না! তখনিই মীর জাফরকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন ক্লাইভ, কেন এমন প্রতিরোধ হচ্ছে? মীর জাফর তাকে উত্তর পাঠান, নবাবের বাহিনী কোনো যুদ্ধ করছে না, যারা লড়ছে তারা মীর মর্দান আর মোহনলালের বাহিনী। শুধু তাদের পরাস্ত করতে পারলেই হবে, আপনি জিতে যাবেন। 

তারপর যুদ্ধ চলতে থাকে সকাল থেকে একভাবে। হঠাৎ দুপুর নাগাদ আকাশে জমে আশে মেঘ। শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি পলাশিতে। ধুরন্ধর ইংরেজ বাহিনী নিজেদের কামান আর গোলাবারুদ তারপুলিন দিয়ে ঢেকে ফেললেও নিজেদের কামান আর গোলাবারুদ ঢাকতে ব্যর্থ হয় নবাব সিরাজের সেনা বাহিনী। যার ফলে বৃষ্টিতে ভিজে অকার্যকর হয়ে যায় নবাব বাহিনীর গোলাবারুদ। হঠাৎ দুপুর বেলা তিনটার দিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হঠাৎ ইংরেজদের একটি কামানের গোলা এসে আঘাত করে মীর মর্দানের বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বীর সেনাপতি। তাকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। মীর মর্দানের এই মৃত্যু নবাব মেনে নিতে পারেননি, চিন্তায় পড়ে যান নবাব সিরাজ, বৃথা যায় মীর মদনের আত্মত্যাগ।  

অবশেষে খুজে পাওয়া গেল নবাব সিরাজ উদ-দৌল্লাহ বর্তমান পরিবার

মীর মর্দানের যারা অনুগত সৈনিক ছিলেন তারা তাদের প্রিয় সেনাপতির দেহ ফেলে আসেননি যুদ্ধের ময়দানে। তারা তার মৃতদেহকে গোপনে বহন করে নিয়ে আসেন পলাশী গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ফরিদপুর গ্রামে। তাকে সমাহিত করা হয় সেখানেই। কিন্তু ইতিহাস এই বিশ্বাসঘাতকদের ছেড়ে দেয়নি, অপরদিকে সম্মান এবং মর্যাদায় আসীন হয়ে আছেন সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল, নয়ে সিং হাজারি ও বাহাদুর খানের মতো দেশপ্রেমিক নবাবের সেনানায়করা। যারা যুগ যুগ ধরে হয়ে থাকবেন বাংলার প্রতিটি মানুষের মনিকোঠার মর্যাদায়। 

Published By: BIPRADIP DAS


Share This

0 Comments: